বৈষ্ণবরা দুর্গাপুজোর বিরোধিতা কেন করেন ?

বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় নিঃসন্দেহে সমস্ত বাঙালির শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব হলো দুর্গাপুজো কথা কারও অজানা নয় এটি মূলত শাক্ত সম্প্রদায়ের আরাধনা, যেখানে দেবী দুর্গাকে সর্বশক্তিময়ী ঈশ্বরী রূপে পুজো করা হয় যা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালির হৃদয়ে চিরতরে জায়গা করে নিলেও, হিন্দুধর্মের আরেক গুরুত্বপূর্ণ শাখা বৈষ্ণব ধর্ম  এই পুজোর প্রতি অতটা সহানুভূতিশীল নয় ইতিহাস, শাস্ত্র, আধ্যাত্মিক দর্শন এবং ব্যক্তিগত ভক্তির ভিত্তিতে প্রায় সমগ্র বৈষ্ণব সম্প্রদয় দুর্গাপূজাকে আচারগতভাবে গ্রহণ করেন না
তারা বিশ্বাস করেন যে পরম ঈশ্বর একজনই শ্রীবিষ্ণু বা তাঁর অবতার শ্রীকৃষ্ণ বৈষ্ণব দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে ভক্তি বা ঈশ্বরপ্রেম তাদের মতে, অন্যান্য দেব দেবীরা প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির প্রতিনিধি মাত্র, এবং তাঁদের পূজা করলে সাময়িক ফল পাওয়া গেলেও পরম মুক্তি লাভ সম্ভব নয় কারণে বৈষ্ণবরা শুদ্ধ ভক্তি পথের বাইরে গিয়ে অন্য দেবতার পূজায় অংশগ্রহণ তো দূরের কথা বিরোধিতা করতেও পিছপা হননি, বাদ পড়েনি বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবও তাদের এহেন কার্যকলাপের সুস্পষ্ট চিহ্ন প্রথম লক্ষ্য করা যায় মধ্যযুগে, বিশেষ করে ১৫শ ১৬শ শতকে যখন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম বিস্তার লাভ করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নেতৃত্বে শ্রীচৈতন্য প্রচার করেছিলেন যে কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণ নামস্মরণ প্রেমভক্তিই এই কলিযুগে পরম মুক্তির পথ তিনি কোনোদিনও শাক্ত উপাসনায় অংশগ্রহণ করেননি, এবং তাঁর অনুগামীদেরও একনিষ্ঠ কৃষ্ণভক্তির নির্দেশ দেন তাঁর শিষ্য শ্রীল রূপ গোস্বামী যিনি ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্যের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভক্ত, শিক্ষক (গুরু), কবি এবং দার্শনিক, যিনি তাঁর ভক্তিরসামৃতসিন্ধুগ্রন্থের পূর্ব ভাগ প্রথম লহরীর ১১ তম শ্লোকে (..১১) লিখেছেন,
অন্যাভিলাষিতা শূন্যং জ্ঞান কর্মাদ্যনাবৃতম্
আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তির উত্তমা
অর্থাৎ, যে ভক্তি কৃষ্ণ ব্যতীত অন্য কোন কামনায় আবদ্ধ নয়, জ্ঞান বা কর্মের দ্বারা আচ্ছন্ন নয়, এবং যা অনুকূলভাবে কৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত তাকেই শ্রেষ্ঠ বা উত্তম ভক্তি বলা হয়
আবার, শ্রীল রূপ গোস্বামীর ভাগ্নে শিষ্য শ্রীল জীভ গোস্বামী যিনি ছিলেন ষড়গোস্বামীদের (ষষ্ঠ গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্য) অন্যতম তিনি ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থের ব্যাখ্যা বা টীকা তে লিখেছেন
হরৌ অনন্যতা
না তুদেবতা-অন্তরিততা স্বশক্ত্যাদিভিরাবৃতিঃ
অনন্যতা তু সা প্রোক্তা কৃষ্ণানুকূল্যসেবনম্
অর্থাৎ, ভগবান হরির প্রতি অনন্যতা মানে এই নয় যে, অন্য দেবতাদের প্রতি বিদ্বেষ থাকতে হবে কিন্তু তাঁদের পূজা করা উচিত নয় একমাত্র হরিকেই আরাধ্য মনে করতে হবে।
বৈষ্ণবরা দেবী দুর্গাকে ত্যাগ করেন না, বরং তাঁকে 'যোগমায়া' বা ভগবানের অভ্যন্তরীণ শক্তির একটি রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে, ‘মহামায়াহলো জাগতিক বিভ্রান্তির জড় জগতের অধিষ্ঠাত্রী এক তামসিক দেবী, তিনি ত্রিগুণ (সত্ত্ব, রজ, তম) দ্বারা এই জগতকে পরিচালনার মাধ্যমে জীবাত্মাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখেন অর্থাৎ, তিনিই জীবকে ভোগে লিপ্ত রাখেন এবং জাগতিক বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখেন, যা জীবকে সংসারে বেঁধে রাখে তাই তাঁর পুজো মোক্ষের পথে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে আরযোগমায়াহলো সেই শক্তি, যা ভক্তিকে উৎসাহিত করে কৃষ্ণলীলার আয়োজন করে
শাক্তরা যেখানে দুর্গাকে স্বয়ং পরব্রহ্ম বা আদিশক্তি রূপে পূজা করেন, বৈষ্ণবরা তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের শক্তির অধীনে একজন সেবিকা হিসেবে দেখেন যিনি ভক্তদের মোহমুক্ত করে ভগবানের দিকে যেতে সাহায্য করেন যেমন, শ্রীশ্রীচণ্ডীতে উল্লিখিত মধু-কৈটভ বধের সময় বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগানোর জন্য যে দেবীর স্তব করা হয়েছিল, তিনিই যোগমায়া এবং পরে তিনিই মহামায়া রূপে মধু-কৈটভকে মোহাচ্ছন্ন করেছিলেন তাদের মতে, মহামায়া বদ্ধ জীবকে আবদ্ধ রাখেন, আর যোগমায়া ভক্তকে ভগবানের সঙ্গে যুক্ত করেন দেবী দুর্গা উভয় রূপেই শ্রীকৃষ্ণের সেবিকা
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ISKCON-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভুপাদ যিনি তাঁর অনুবাদিত ভাগবত গীতায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, “দেবী দুর্গা হলেন বিষ্ণুর দাসী তাঁর পূজা করা উচিত নয় মোক্ষপ্রার্থীদের, কারণ তিনি এই জড়জগতের শক্তি ভগবান শ্রীকৃষ্ণই সর্বোচ্চ, তাঁরই আরাধনা মোক্ষ এনে দিতে পারে
শ্রীমদ্ভগবত গীতার .২০ তম শ্লোক
কামৈস্তৈস্তৈঃ হৃতজ্ঞানাঃ
প্রপদ্যন্তে অন্য-দেবতাঃ
তং তং নিয়মমাস্থায়
প্রকৃত্যা নিয়তা স্বয়া
অর্থাৎ, যাদের জ্ঞান কামনাদ্বারা হরণ করা হয়েছে, তারা অন্য দেবতাদের শরণ গ্রহণ করে তারা নিজ নিজ স্বভাব অনুযায়ী নির্দিষ্ট নিয়ম পালন করে সেইসব দেবতাদের উপাসনা করে
শ্রীল প্রভুপাদ এটিকে কেন্দ্র করে তাঁর ভাবানুবাদে লিখেছেন,
“The worship of demigods is for less intelligent people. The ultimate goal is Krishna. Therefore, intelligent people worship only Krishna.”
গৌড়ীয় মঠের প্রবর্তক শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর বলতেন, “দেবী পূজার মাধ্যমে আমরা কেবল বস্তুভোগের আকাঙ্ক্ষা করি প্রকৃত ভক্তি ত্যাগ, আত্মসমর্পণ কৃষ্ণপ্রেমে নিহিত
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর একজন বিশিষ্ট গৌড়ীয় সাধক, যিনি নবদ্বীপে বৈষ্ণব ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটান তিনি তাঁর লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন, দুর্গাপূজা অন্যান্য শাক্ত আচারের প্রতি ভক্তের আসক্তি একপ্রকার বিভ্রান্তি
বাংলার মতো সমাজে, যেখানে দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক সামাজিক উৎসব সেখানে বৈষ্ণবদের বিরোধিতা প্রায়ই দ্বন্দ্বের রূপ নিয়েছে  শাস্ত্রের আলোকে বৈষ্ণব দর্শনে দেবী দুর্গাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা লেও পূজার মুখ্য উদ্দেশ্য থেকে তাঁকে পৃথক রাখা হয় তারা বিশ্বাস করেন, দেবী দুর্গা স্বয়ং কৃষ্ণের নির্দেশে এই জগত পরিচালনা করেন তাই কৃষ্ণভক্তির পথ থেকে বিচ্যুতি না করেই তাঁকে সম্মান জানানো যেতে পারে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বহু বৈষ্ণব দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতাকে গ্রহণ করেন না, যদিও সামাজিক সৌহার্দ্য বজায় রাখেন

 

Post a Comment

0 Comments