শ্রীকৃষ্ণ কি বামপন্থী ছিলেন, কী বলছে শাস্ত্র ?

রাজনৈতিক ভাবেই হোক অথবা সিনেমাটিক ভাবে, বর্তমানে ধর্ম চর্চা একটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়ার চায়ের দোকানে অথবা সামাজিক মাধ্যমের দেওয়ালে, শাস্ত্রের দোহাই দিতে প্রায়ই দেখা যায়। সরকারি চাকরির সীমিত আসন সংখ্যার জন্য যে পরিমানে আবেদনপত্র জমা পড়ে তার থেকেও "শাস্ত্রে লেখা আছে" এই বাক্যটি ব্যবহারকারি তরুণ/তরুণীর সংখ্যা বর্তমানে অনেক বেশি। 
না, নাট্য শাস্ত্র বা সঙ্গীত শাস্ত্র নয়, আলোচ্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করে শাস্ত্র বলতে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গুলির কথা বোঝানো হয়ে থাকে। বাস্তব জীবনের সাথে এই গ্রন্থ গুলির আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি না, থাকলেও তা কীভাবে আছে, আধ্যাত্মিকতার সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে গ্রন্থ গুলির তথ্য ডিকোড করা তো দূরের কথা, অনেকে হয়তো জানেই না এই ধর্মগ্রন্থগুলির প্রকারভেদ সম্পর্কে।
সংখ্যায় একাধিক হওয়ায় তথ্য ও সময়ের ভিত্তিতে এগুলি প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয় "শ্রুতি" ও "স্মৃতি"।
"শ্রুতি" হল হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহ, যা কোনো মানুষের দ্বারা রচনা করা হয়নি কারন, লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতি আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন মুনি ঋষি দের আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও সামাজিক চেতনার কথা শুধুমাত্র শুনে শুনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখত। শুনে মনে রাখা হত বলেই শ্রুতি নামটি এসেছে। এগুলি প্রধানত,
১. বেদ (৪টি খন্ড) – ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ,  অথর্ববেদ।
২. উপনিষদ/বেদান্ত (১০৮ টি প্রধান, বৈদিক ভাবে প্রমাণিত ১১ টি) – ঐতরেয়, কঠ, কেন, ছান্দোগ্য, ঈশ, বৃহদারণ্যক, শ্বেতাশ্বতর, তৈত্তিরীয়, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডূক্য উপনিষদ।
৩. ব্রাহ্মণ – বেদের আচার ও ব্যাখ্যা বিষয়ক অংশ।
৪. আরণ্যক – সাধনামূলক ও দর্শনমূলক তথ্য।
"স্মৃতি" হল, ঋষি মুনি দ্বারা সরাসরি সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন গ্রন্থ সমূহ। যেগুলি প্রধানত,
১. রামায়ণ – ঋষি বাল্মীকি রচিত।
২. মহাভারত – ঋষি বেদব্যাস রচিত। (এর অংশ ভগবদ্গীতা হলো একটি বিশেষ দর্শনের গ্রন্থ)
৩. পুরাণসমূহ (১৮টি): বেদব্যাস রচিত ১৮ টি পুরাণ হলো- ব্রহ্মা, পদ্ম, বিষ্ণু, শিব, ভাগবত, নারদ, মার্কণ্ডেয়, অগ্নি, ভবিষ্য, ব্রহ্মবৈবর্ত, লিঙ্গ, বরাহ, স্কন্দ, বামন, কূর্ম, মৎস্য, গরুড়, এবং ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ। 
৪.  ধর্মশাস্ত্র/স্মৃতিশাস্ত্র (১৮ - ১০০র বেশি): বেদের উপর ভিত্তি করে লেখা এবং রচয়িতার নামেই নামকরণ করা, এগুলির মধ্যে মনুস্মৃতি, পরাশর সংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা, গৌতম স্মৃতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
৫. সূত্র সাহিত্য: শ্রুতি সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিয়ে লেখা যেমন- ধর্মসূত্র, শ্রৌতসূত্র, গৃহ্যসূত্র, যোগসূত্র।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা কোনও মুল ধারার ধর্মগ্রন্থ না হলেও একটি বিশেষ সম্প্রদায় এটিকে তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই মনে করে থাকেন। গীতা হল এক ধরনের দর্শন, যা মানুষের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত মহাভারতের একটি বিশেষ অংশ থেকে শ্রীকৃষ্ণের বাণী গুলিকে আলাদা করে নিয়ে এই দর্শন মূলক গ্রন্থটির সৃষ্টি করা হয়েছে। এই গীতারই একাধিক শ্লোকে উল্লেখ রয়েছে সাম্যবাদের কথা।
প্রথমত, আত্মার সাম্য (Equality of Souls)
শ্লোক ৫.১৮ঃ
"বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি ।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ ॥"
অর্থাৎ, যিনি বিদ্যাশীল ও নম্র ব্রাহ্মণ, গরু, হাতি, কুকুর এবং চণ্ডাল সকলের মধ্যেই সম আত্মা দর্শন করেন, তিনিই প্রকৃত পণ্ডিত।
দ্বিতীয়ত, কর্মের সাম্য (Equality in Action)
শ্লোক ২.৪৭ঃ
"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সংঘোস্ত্বকর্মণি॥"
অর্থাৎ, তোমার অধিকার শুধুমাত্র কর্মে, ফলের উপর নয়।
তৃতীয়ত, সকলের প্রতি সমভাব (Equanimity towards All)
শ্লোক ৬.৯ঃ 
"সুহৃদ্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু ।
সাধুষ্বপি চ পাপে চ সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে ॥"
অর্থাৎ, যিনি বন্ধু, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, ঘৃণাকারী, আত্মীয়, সৎ ও পাপীদের প্রতিও সম মনোভাব পোষণ করেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ যোগী।

বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক মতবিরোধ ও ধর্মীয় বিভেদের চরম সীমায় দাঁড়িয়ে যে গ্রন্থ আজও প্রাসঙ্গিক, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। শ্রীমদ্ভগবদগীতার এই আত্মিক সমতা, কর্মে মর্যাদা, সকল জীবের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক হলেও তা আধুনিক সাম্যবাদ (Equality) ও  মানবতাবাদের (Humanism) সঙ্গে মিল রেখে চলে যা বামপন্থার মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়।

Post a Comment

0 Comments