অবচেতনে গো মাতা, বোঅ্যানথ্রপির রোষে মানুষ কিং-বা দেবতা

ভুত, প্রেত, আত্মারা শুধু মাত্র মানুষের উপরেই কেন ভর করে, এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল মানুষের মস্তিষ্ক এতটাই জটিল ও অজানা রহস্যে পরিপূর্ণ যে সেই জটিলতার সরলীকরণ করা বা সেই রহস্য উন্মোচন করা এক জীবনে যথেষ্ট নয়। তাই হয়তো মৃত্যুর পরে শুধু মানুষের আত্মা নয়, অন্য প্রাণীদের আত্মারও মানব মস্তিস্ক এক্সপ্লোর করাতে এসেছে বারবার।

সময়ের সাথে ভুতে ধরার প্রবণতা কমে গেলেও গ্রামে গঞ্জে এখনও কোনো ঠাকুর বাড়িতে বিশেষ করে মনসা, কালি, অথবা অন্য কোনো দেবদেবী একটি নির্দিষ্ট নারী অথবা পুরুষ লোকের উপর ভর করেছে বলে শোনা যায়। এবং আজও লোকে ভীড় জমায় এই বিশ্বাসে যে, ভগবান সেই লোকটির মাধ্যমে তার দুঃখ নিরাময়ের উপায় বলেদেবেন।
এই ভর করা ব্যাপারটা নিয়ে যতই বুজরুকি চলুকনা কেন, প্যারাসাইট বা পরজীবীর মত অন্যের শরীর দখল করে থাকার নিদর্শন প্রাচীন যুগের ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাস্কর্য ও মাইথলজির একাধিক জায়গায় পাওয়াযায়। যার অন্যতম নিদর্শন হল মিশরের স্ফিংসের মূর্তি, সিংহের দেহ কিন্তু মাথা মানুষের। এছাড়া প্রাচীন মিশরীয় দের মমিফিকেশনের দেবতা “আনুবিস” যার মানুষের শরীরে বসানো শেয়ালের মাথা, যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার দেবতা “হোরাস” একজন বাজ পাখির মাথা যুক্ত দেবতা, নীল নদের দেবতা “সোবেক” একজন কুমিরের মাথাওয়ালা দেবতা। এমনকি হিন্দু মাইথলজিতে গণেশের শরীরে হাতির মাথা আবার বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার যিনি মানুষ ও সিংহের সংমিশ্রনে তৈরি। এরকম অনেক দৃষ্টান্তই লক্ষ্য করা যায়।
আবার, ইউরোপীয় মহাদেশের বিভিন্ন কল্পকাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রামের লোককথা অনুযায়ী তান্ত্রিক শাস্ত্রে এমন কাহিনির উল্লেখ আছে, যেখানে মানুষ অন্য প্রানির মত আচরণ করে এমনকি নিজেকে সেই প্রাণী বলে দাবি করে। এগুলো কালাজাদু বা ভৌতিক প্রভাব বলে ব্যাখ্যা করে থাকেন অনেকেই। 
এরকম প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে মানুষ থেকে অন্য প্রাণিতে রূপান্তরিত হওয়ার সন্ধিক্ষন ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মিশ্র ক্রিয়েচার, যাদের মধ্যেদুটি প্রাণীরই বৈশিষ্ঠ আংশিক ভাবে লক্ষ্য করা যায়। এইসব কাহিনীর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না থাকলেও কোনও এক মানসিক রোগের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
যেমন, ঝুলন্ত উদ্যানের নির্মাতা প্রাচীন ব্যাবিলনের বিখ্যাত রাজা দ্বিতীয় নেবুকাডনেজার (৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) যিনি অতিরিক্ত আত্মঅহংকারে ভুগছিলেন তাঁর সম্পর্কে বাইবেলে উল্লেখ আছে, তিনি ঈশ্বরের  অভিশাপে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন এবং সাত বছর ধরে গবাদি পশুর মতো আচরণ করতেন, মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াতেন, ঘাস খেতেন, নিজের নখ চুলও কাটতেন না। আধুনিক গবেষকরা এটিকে বোঅ্যানথ্রপির (Boanthropy) প্রাচীনতম দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখেন।
আধুনিক সাহিত্যেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। ফ্রাঞ্জ কাফকার "দ্য মেটামরফোসিস" গল্পে মূল চরিত্র "গ্রেগর সামসা" একটি পোকায় রূপান্তরিত হয়, যা অ্যান্থ্রোপোমরফিক ডিলিউশনের ধারায় পড়ে যেখানে মানুষ নিজেকে প্রাণী বলে বিশ্বাস করে এবং অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে।

এই রকম অস্বাভাবিক আচরণ ও বিচিত্র শারীরিক ভঙ্গি প্রাথমিক ভাবে পাগলামি ভেবে ভুল করলেও এর পেছনে থাকতে পারে কোনো গভীর কারণ।
বোঅ্যানথ্রপি (Boanthropy) হল সেইরকমই এক কারন, একধরনের বিরল  মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রম, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে কোন গবাদি পশু বলে মনে করে এবং তার মতো আচরণ করতে শুরু করে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কখনও গরুর মতো চার পায়ে হাঁটে, কখনও বা হাম্বারবে ডাকে আবার কখনও চারণভূমিতে বিচরণ করে, ঘাস খাওয়ার চেষ্টা করে। মধ্যযুগের ইউরোপে ওয়‍্যারউল্ফ (Werewolf) সন্দেহে অনেক মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, হতে পারে তাদের মধ্যে কেউ লাইক্যানথ্রপি (Lycanthropy) নামক আরেক বিরল রোগে আক্রান্ত ছিল, এই ক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে নেকড়ে ভেবে নেকড়ের মত আচরন করে। সাইন্যানথ্রপি (Cynanthropy) একই রোগের আরেক পর্যায় যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে কুকুর ভাবে এবং কুকুরের মতই আচরণ করতে থাকে। যদিও এই সমস্ত রোগ গুলি খুবই কম দেখা যায় তবুও সব ক্ষেত্রেরেই আক্রান্তরা মানুষের সমাজ থেকে সম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালায়।

এই সব রোগের বা মানসিক অবস্থার কারন এখনও পরিষ্কার নয় তবে দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ, অবদমিত ইচ্ছা বা সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে মস্তিষ্কের এই রূপ বিকৃতি দেখা দিতে পারে। ফ্রয়েডের মত মনোবিশ্লেষকরা বলেন, কোনও এক গভীর মানসিক প্রভাব বা স্বপ্ন থেকে এই বিভ্রমের জন্ম হতে পারে। সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের একটি লক্ষণ হিসেবেও বোঅ্যানথ্রপির মত রোগের প্রকাশ ঘটতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মাত্রায় অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলেও এমন হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। আবার কেউ যদি হিপনোসিসের অধীনে থাকে এবং তাকে প্রাণীর মতো আচরণ করতে বলা হয়, সেই অভিজ্ঞতা তার মনোজগতে গেঁথে যেতে পারে।
বর্তমানে এগুলি অত্যন্ত দুর্লভ মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ বিষয়ে গবেষণা সীমিত, কিন্তু কিছু সাইকিয়াট্রিক কেস স্টাডিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। আধুনিক মনোরোগ চিকিৎসায় বোঅ্যানথ্রপির মত রোগকে একটি ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার বা জটিল সাইকোসিস হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এর কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তবে চিকিৎসা সাধারণত নির্ভর করে মূল রোগ নির্ণয়ের উপর সাইকোথেরাপি (CBT), অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ, সমর্থনমূলক কাউন্সেলিং, জৈবিক কারণ থাকলে নিউরোলজিকাল চিকিৎসা। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পরিবার ও সমাজের সহানুভূতিশীল ভূমিকা। কারণ মানসিক রোগের মোকাবেলায় সামাজিক সমর্থন খুব জরুরি, মনোবিদরা এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলে থাকেন।

মানুষের মস্তিষ্কের এই জটিলতা থেকে বলা যায় বোঅ্যানথ্রপি সহ এই ধরনের অদ্ভুত রোগ গুলি শুধুই অদ্ভুত রোগ নয়, বরং এগুলি মানুষের মানসিক জগতের অসীমতা এবং মনস্তাত্ত্বিক রহস্যের প্রতিচ্ছবি। ইতিহাস, ধর্ম এবং মনোবিজ্ঞানের এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ। মনের অদম্য কল্পনার সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ।

Post a Comment

0 Comments